সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনে রামাদানের গুরুত্ব অপরিসীম

সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনে রামাদানের গুরুত্ব অপরিসীম

এম সোলাইমান কাসেমী: পবিত্র মাহে রামাদান বর্ণনাতীত মাহাত্ম্য, গুরুত্ব ও মর্যাদাপূর্ণ মাস। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে মাহে রামাদান আমাদের উপর ছায়া বিস্তার করছে। অবাধ্য ও সীমালংঘনকারী নফসের মুখে লাগাম কষে আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের অবারিত সুযোগের হাতছানি। এ মাসেই নাযিল হয়েছে মানব জাতির জন্য চূড়ান্ত গাইড লাইন পবিত্র “কুরআন শরীফ”। আল্লাহর সমস্ত আসমানি কিতাবও এই মাসে নাযিল হয়েছে বলে হাদীস শরীফের সমর্থন রয়েছে। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতদের প্রতি শ্রেষ্ঠ খোদায়ী পুরস্কার হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ রজনী লাইলাতুল কদর ও এই মাসে। পবিত্র রমযানের সিয়াম সাধনা এমন ইবাদত যা প্রতি মুহূর্তে মানব মনে খোদাভীতি জাগ্রত করে। মূলত পবিত্র রামাদান হচ্ছে তাকওয়া অর্জনের খোদায়ী ট্রেনিং। কিন্তু পরকালীন অর্জন ও দুনিয়ায় বর্জনের এই মাসের প্রকৃত চেতনা আমাদের এতটুকু অবশিষ্ট নেই। পবিত্র রামাদান মাসকে কেন্দ্র করে চলে মজুদদারি ও মুনাফা অর্জনের প্রতিযোগিতা। রমযানের মৌলিক শিক্ষা সংযম ও খোদাভীতি তা আমাদের দুর্নীতির উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। অশ্লীলতা-বেহায়াপনা সাময়িকভাবে খোলসে আশ্রয় নিলেও রমযান পরবর্তীতে তীব্রতা বেড়ে যায়, যা রমযানের প্রকৃত শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত।

ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন এবং তাকওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণের নিমিত্তে রোযার বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন “হে ঈমানদারগণ!, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। আশা করা যায় যে, তোমরা খোদাভীরু হবে। (সুরা বাকারা-১৮৩)। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-“রামাদান এমন একটি মাস যাতে অবতীর্ণ করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়াত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশক ও হক-বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী দলিল। তোমাদের মধ্যে যে এ মাসটি পায় সে যেন অবশ্যই তাতে রোযা পালন করে- (আল বাকারা-১৮৫)। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইরশাদ করেন- যে লোক রমযান মাসে রোযা রাখবে ঈমান ও ইহতেছাবের সাথে তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহ মাফ হয়ে যাবে”। (বোখারী, মুসলিম ও তিরমিযী) অন্য হাদীসে রাসূলে পাক (সা.) ইরশাদ করেন, হযরত সাহল ইবনে সা’য়াদ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, বেহেশতে একটি দরজা আছে, উহাকে “রাইয়ান” বলা হয়। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন একমাত্র রোযাদারগণই বেহেশতে প্রবেশ করবে। রোযাদার ছাড়া অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবেনা, সেদিন এ বলে ডাকা হবে, রোযাদারগণ কোথায়? তারা যেন এ পথ দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করে। এভাবে সকল রোযাদরগণ ভিতরে প্রবেশ করার পর দরজাটি বন্ধ করে দেয়া হবে। অত:পর এপথে আর কেউ প্রবেশ করবেনা। (বোখারী ও মুসলিম)।

হযরত রাসূল (সা.) বলেন, আমার উম্মতকে আল্লাহ তায়ালা পাঁচটি জিনিস দান করেছেন যা আমার পূর্বে কোন নবীকে দান করা হয়নি। (১) রমযান মাসে প্রথম রাতে আল্লাহর দৃষ্টিপাত। যার উপর এ দৃষ্টি পড়বে তাকে শাস্তি দেবেনা। (২) জান্নাতকে সজ্জিত হওয়ার নির্দেশ। যাতে সেখানে রোযাদারগণ আরাম আয়াসে থাকতে পারে। (৩) রমযানের শেষ রাতে ক্ষমা। (৪) শবে কদরের রাতে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। (৫) রোযা শেষে শ্রমিকদের ন্যায় পূর্ণ মজুরি দান তা হচ্ছে ক্ষমা। (বায়হাকী)। আর রোযার মাধ্যমে রোযাদারগণ সাধারণত নিমোক্ত বৈশিষ্ট্যরাজি হাছিল করে থাকেন। (১) আল্লাহর সন্তুষ্টি (২) আল্লাহর ক্ষমা প্রদর্শন (৩) আল্লাহর জিম্মাদারী (৪) আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসা (৫) আল্লাহর নিয়ামত লাভ। তাই সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ প্রবৃত্তির তাড়না থেকে পরিত্রাণ পায়। যার ফলে লোভ-লালসা, কামনা, বাসনা, ক্রোধ, নেশা, মিথ্যা, প্রতারণা এবং অশ্লীলতার চর্চা থেকে পুত পবিত্র হয়ে সে একটি সুন্দর ও আদর্শ জীবন লাভ করে। এ জীবনের প্রভাব যে সমাজে পড়ে সে সমাজ আদর্শ সমাজ হিসেবে গড়ে ওঠে। কিন্তু আজ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে সন্ত্রাস নামক ব্যাধি। ব্যবসা, শিক্ষা, রাজনীতি সব কিছুই এর ভয়াল আঘাতে হুমকির সম্মুখীন। কিন্তু ইসলাম সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে কখনো সমর্থন করে না। আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক ও সমাজ সংস্কারক হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতিকারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। যার ফলে নেমে এসেছে এ পৃথিবীতে সুখ-শান্তি আর শৃংখলা। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে অতি অল্প বয়সেই অন্যায়ও অসত্যের প্রতি চরম ঘৃণা, ন্যায় ও সত্যের জন্যে আপোষ হীনতা, ত্যাগ, ধৈর্য, আমানতদারী, বিশ্বস্ততা, ইনসাফ ইত্যাদি বিরল গুণের অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল, যে কারণে সমাজে তিনি পরিচিত পান “আল আমীন” তথা বিশ্বাসীরূপে।

হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মাত্র ১৭ বছর বয়সে সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা ও জুলুম এবং অন্যায় প্রতিরোধের জন্যে “হিলযুল ফুযুল” নামক কল্যাণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। আজ বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যা সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ। বিশ্ব জুড়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের দরুন মানুষ আজ চরমভাবে আতঙ্কগ্রস্ত। মানুষের সুখের নীড় ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যাচ্ছে এ সন্ত্রাসের কারণে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ গুলোতে সন্ত্রাস একটি অতি পরিচিত পরিভাষা। বাংলাদেশেও এর আওতামুক্ত নয়, নৈতিক অবক্ষয় ও স্বার্থের সংঘাতের অনিবার্য ফলশ্রুতি হচ্ছে সন্ত্রাস। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে তাকে পর্যদুস্ত করার প্রবনতা আজ বিশ্বের সর্বত্র। সারা বিশ্বে আজ অহরহ সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সংঘটিত হচ্ছে এবং তার বিভিষিকাময় প্রতিক্রিয়ায় মানুষ আজ চরমভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
অতএব, সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনে সিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে মানুষের মাঝে খোদাভীতি সৃষ্টি হয়। ফলে মানুষ বিভিন্ন পাপাচার থেকে দূরে থেকে সৎ কাজের প্রতি উৎসাহিত হয়। তাই সিয়ামের এ মহান শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে উপলদ্ধি করা আমাদের প্রত্যেকের উচিত।

লেখক : মাওলানা এম সোলাইমান কাসেমী, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।